তাহেরদের কষ্ট দেখার কেউ নেই

Source: banglanews24.com

সুয়েজ (মিশর) থেকে: চোখের জলেও ভেজে না মরুভূমির শুষ্কতা! কিন্তু অসহায় কান্নাই যেন সঙ্গী আবু তাহের আমিন গাজীর (২৮)। আজ ছয় মাস হতে চললো। বেতন নেই। বাড়িতে একটি টাকাও পাঠাতে পারেন নি। কী করে যে দিন কাটে, রাত যায়। সেই খবরও নেবার যেন কেউ নেই!

শরীয়তপুর জেলার পালং থানার বুড়িরহাট গ্রামের আমিন গাজীর ছেলে আবু তাহের। প্রায় ১০ বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম সপ্তাশ্চর্য পিরামিডের দেশ মিশরে। স্বপ্ন ছিলো ভাগ্যবদলের। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার। সেই স্বপ্নই এখন দুঃস্বপ্ন। চোখে এখন মরুর ধূসরতা।

শ্রমিক নয়। পর্যটক পরিচয়েই দেশটিতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু আবু তাহেরের মতো মানুষদের কখনোই তা জানার উপায় ছিলো না। তবে, দালালদের হাতে গুঁজে দিতে হয় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।

এখনকার হিসাবে ভিসা ফি মাত্র ৩২শ’ টাকা আর তখনকার হিসাবে যাতায়াত ভাড়া ছিলো মাত্র ৩০ হাজার টাকা।

আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দুটি ফ্লাইটে ৩৩ জন এদেশে এসেছিলাম। রাজধানী কায়রোর গিজায় একটি কারখানায় নেওয়া হলো। বেতন ধরা হলো ১৩০ ডলার। এখানকার মুদ্রা মানে প্রায় দশ হাজার টাকা।

কিসের বেতন। উল্টো আমাদের গাধার মতো খাটিয়েও বেতন দেওয়া হতো না। কেড়ে নেওয়া হলো আমাদের পাসপোর্ট।

বলা হতো, তোমরা অবৈধ শ্রমিক। কোথাও নালিশ করতে গেলেই ধরা পড়বে। জেলে পচতে হবে। দিনের পর দিন বেতন না পেয়ে শেষে পাসপোর্টের আশা ছেড়েই পালিয়ে গেলাম রামসিসে।

সেখানেও হয়রানি। নেই পাসপোর্ট। নেই ভিসা। এভাবে বঞ্চনার ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে চলে যাই সুইচে। সেখানে জোরায়ের এলাকায় মানু টেক্স নামে কারখানায় কাজ নিই। এখানে মন্দের ভালো হিসেবে উৎপাদন ব্যবস্থাপক (পিএম) হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা পেতাম।

বাবা মা সুদ ও ধারদেনা করে দালালের হাতে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা তুলে দিলেও দালাল আরও ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। দেবো কোত্থেকে। এর মধ্যে সুদে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ টাকা।

জোরায়ের এলাকায় মানু টেক্স নামে কারখানায় আবু তাহেরের সন্ধানে গিয়ে তাকে দেখা যায়, একটি সেলাই মেশিনের সামনে। অলস সময় কাটাতে। বিমর্ষ চেহারা। চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা আর অনিশ্চয়তা তখন সঙ্গী।

জানালেন, কষ্টে আগে দিনাতিপাত করলেও এখন যেন দিনগুলো কাটছেই না তার। বেশ মন্দা চলছে মিশরের অর্থনীতিতে। কারখানায় কোনো কাজ নেই। তার মাঝে ডলারের বিপরীতে কমছে মিশরীয় পাউন্ডের দাম। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তেলের দাম। সঙ্গে খাবারসহ নিত্যপণ্যের।

এর মাঝেও ট্যুরিস্ট ভিসায় দালালের হাত ধরে অনেকে পাড়ি দিচ্ছেন এদেশে। ভিসায় কড়াকড়ি থাকায় পাচারকারীদের ট্রানজিট হিসেবে অনেকে সুদান ও লিবিয়া থেকেও আসছেন। যা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ঠেলে দিচ্ছে অজানার দিকে।

আবু তাহের এখনও বিয়ে করেননি। গত ১০ বছরে এখানকার ভাষাও রপ্ত করেছেন বেশ। হয়রানি এড়াতে এখন অনেকেই মিশরের সুয়েজের দিকে আসায় শ্রমিকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে।

তিনি বলেন, এই যে অবৈধভাবে ট্যুরিস্ট ভিসায় এত লোক আসছে। দেশের বিমানবন্দর থেকে তাদের কেন আটকানো হয় না। আমরা এমনিতেই বিপদে। তার ওপর নতুন করে আসা অবৈধ প্রবাসীদের কষ্ট দেখে স্থিরও থাকতে পারি না। নিজের থাকার জায়গাটুকুতেই আশ্রয় দেই। নিজেদের খাবারগুলো দিয়ে তাদের বাঁচাই।

আমি দশ বছরে বাড়ি যাইনি। বাড়ির জন্যে মন কাঁদে। কিন্তু আমার তো ভিসা নেই। বাড়ি গেলে অ্যামবেসি থেকে ট্রাভেল পাস নিয়ে যেতে পারি। তবে, ফেরার দরজা বন্ধ। আর দেশে গিয়েই বা কি করবো! তাহের একা নন। বিয়ের বয়স পার হচ্ছে। তবে, দেশে ফেরার উপায় নেই এমন অনেকের।

এভাবে জীবন থেকে প্রতিটি দিনক্ষণ ঝরে পড়লেও তাহেরদের কষ্ট বোঝার যেন কেউ নেই।

বাংলাদেশ শুধু প্রবাসে আমাদের নিঃশেষ করে দেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গর্বই করতে জানে। জানে না কেবল আমাদের মোমবাতির মতো পুড়ে যাবার কষ্টটুকু বুঝতে-ছলছলে চোখে এই আক্ষেপ তাহেরের।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
পিসি/

BASUG on Facebook